সিলেটের প্রথম মুসলমান হযরত শাহ্ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহ.): ১৩১৩ খিষ্টাব্দে রাজা গৌড় গোবিন্দ সিলেট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড় গোবিন্দের “ গৌড় রাজ্য” প্রতিষ্ঠাকালে বাংলাদেশ পর্যন্ত মুসলিম শাসন ও ওলী আউলিয়ার ইসলাম প্রচার করতে থাকলেও সিলেটে মুসলিম শাসন কায়েম হয়নি।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গৌড় রাজ্যের ঘর দুয়ার (পূর্বের) টিলাগড় টুলকির (বর্তমান) বুরহানবাদ কুশীঘাট মহল্লায় ১৩ পরিবার মুসলমান বাস করতো। সিন্ধু বিজেতা মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম আস সাকাফি অষ্টম শতকের সিন্ধু বিজয়ের পর ১৩ পরিবারের পূর্বপুরুষরা জাহাজের মধ্যে বাংলা আগমন করেছিলেন এবং প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন। দাওয়াতী ও ব্যবসায়ী কারণে, তারা তারপর সিলেটে যান। তুলতিকর মহল্লার যে গ্রামে এই ১৩ পরিবার বসবাস করেছিল, তা এখনও "তেররতন" নামে পরিচিত। ঐ ১৩ পরিবারের প্রধান ছিলেন হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ)। এ জন্য তাকে সিলেটের প্রথম মুসলমান বলা হয়।
হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তার কোন সন্তান ছিল না। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে মানত করেন যদি তার একটি সন্তান হয় তাহলে সে আল্লাহর নামে গরু জবেহ দিবেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, রাজা গৌড় গোবিন্দ ছিলেন একজন মুসলিম বিদ্বেষী অত্যাচারী হিন্দু রাজা ,অত্যন্ত বদমেজাজী এবং জাদু বিদ্যায় পারদর্শী। তার রাজ্যে গরু জবেহ করা এবং পশু হত্যা ছিল নিষিদ্ধ। মুসলমানরা চুপিসারে তাদের ধর্ম পালন করতেন।
আল্লাহর রহমতে কিছু দিন পরে হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এর ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন। ছেলের জন্মের খুশিতে আকিকার অনুষ্ঠান করেন এবং ছেলের নাম রাখেন সৈয়দ গুলজার আলম। গোপনে তিনি তার মানত আদায়ের জন্য একটি গরু জবেহ করেন। এদিকে একটি কাঁক গরুর মাংসের এক টুকরা ছো মেরে নিয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দ এর মন্দিরে ফেলে দেয়। এই ঘটনা রাজা গৌড় গোবিন্দের দরবারে পৌছায় এবং এতে তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে কে গরু জবেহ দিয়েছে তা খুজে বের করার জন্য লোক সৈন্য পাঠায়। সৈন্যরা মুসলিম এলাকায় তল্যাশি করে হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এর বাড়িতে পৌছে দেখে সেখানে গরু জবেহ দেয়া হয়েছে। সৈন্যরা তাকে রাজদরবারে ধরে নিয়ে যায়।
রাজা গৌড় গোবিন্দ তাকে কেন গরু জবেহ দিয়েছেন তার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) তিনি তার মানতের কথা বলেন। রাজা তার কথা শুনে তাকে বন্দী করেন এবং তাঁর শিশুপুত্র সৈয়দ গুলজার আলমকে রাজদরবারে তার সামনে আনতে নির্দেশ দেন।
সৈন্যরা হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এর স্ত্রী সৈয়দা খাতুন জান্নাতের বুকে লাথি মেরে তার সন্তানকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যায়। গরু জবেহ দেযার অপরাধে আটক হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এর সামনে তার শিশু সন্তান সৈয়দ গুলজার আলমকে বলি দেন , দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেন। এরপর অত্যাচারী রাজা হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এর ডান হাত কেটে ফেলেন। শিশু সন্তান সৈয়দ গুলজার আলমকে হত্যার ঘটনা শুনে তার মাতাও ইন্তেকাল করেন।
শুধু এতটুকুই নয়, ওই জালিম রাজা গোবিন্দ ওই দিনই আক্রমণ চালিয়ে ওই এলাকার সকল মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) তার স্ত্রী ও পুত্রকে দাফন করে শিশু সন্তানের মাথা নিয়ে অত্যন্ত ব্যথিত অন্তরে শেখ বুরহান উদ্দিন পায়ে হেঁটে উপস্থিত হলেন সোনারগাঁয়ে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের দরবারে। ইলিয়াস শাহ সব শুনে যালিম হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দকে শাস্তি দেয়ার জন্য সৈন্য-সামন্ত পাঠালেন যুদ্ধ করার জন্য। বেশ কিছুদিন যুদ্ধ হলো, শত শত মুসলিম সৈন্য শহীদ হলো। কিন্তু জয় করা হলো না।
এরপর হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) রওয়ানা হলেন দিল্লির পথে। দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ তুঘলকের সামনে। তিনি বুরহান উদ্দিনের নিকট হতে সব বিষয় শুনে যবন গোবিন্দকে শায়েস্তা করার জন্য সৈন্যসহ সিকান্দার গাজীকে সেনাপতি করে অভিযানে পাঠালেন। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক প্রতিকূলতার কারণে তারা দিল্লিতে ফিরে গেলেন।
অতঃপর নতুন কিছু সৈন্যসহ আর একজন বীর সাইয়্যিদ নাসির উদ্দিনকে সেনাপতি করা হলো। সম্রাটের আদেশ পেয়ে তিনি দোয়া নিতে গেলেন তাঁর পীর শায়েখ হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন (রহ.) এর দরবারে। তখন ওখানেই অবস্থান করছিলেন হযরত শাহ জালাল (রহ.)। সবকিছু শুনে হযরত শাহ জালাল (রহ.)সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও সাইয়্যিদ নাসির উদ্দিনের সাথে এই অভিযানে যাবেন।
অতঃপর হযরত শাহ জালাল (রহ.) তাঁর ৩৬০ জন সঙ্গী নিয়ে সাইয়্যিদ নাসির উদ্দিনের সৈন্যবাহিনীর সাথে রওয়ানা দিলেন।
পথিমধ্যে গৌর গোবিন্দের সৈন্যদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ওলীয়ে কামিলগণ উনাদের দোয়া, মহান আল্লাহ পাক উনার গায়েবী মদদ এবং হযরত শাহজালাল (রহ.) উনার রূহানিয়তের নিকট গৌর গোবিন্দের যাদুমন্ত্র অকার্যকর হয়ে তার বাহিনীর চরম পরাজয় হলো। নিহত হলো গোবিন্দের সেনাপতি মনা রায়। মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হতে থাকলো গৌর গোবিন্দের রাজধানী অভিমুখে। সুরমা নদী পার হয়ে মুসলিম বাহিনী যখন প্রাসাদের নিকটবর্তী হলো, তখন হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দ প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুসলমানের আযানের ধ্বনিতে গৌর গোবিন্দের প্রাসাদ ও মন্দির ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এবং তাঁর পরিবারের ত্যাগের বিনিময়েই উদিত হলো নতুন সূর্য। উড়তে লাগলো ইসলামের পতাকা। গৌর গৌবিন্দের রাজ্যের নতুন নাম হলো জালালাবাদ।
সিলেট শহরের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে সুরমা নদীর তীরে সিলেট পৌরসভার আওতাধীন টুলটিকর কুশিঘাট এলাকায় হযরত শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (রহঃ) এর ঐতিহাসিক বাড়িতেই তাঁর মাজার অবস্থিত।
0 Comments