জন্মের পর এই মহান ওলীর নাম রাখা হয়েছিল
মুহাম্মাদ আলী । পরবর্তীতে তিনি নিজে তাঁর লেখা কয়েকটি বইয়ে নাম লিখেছেন-
‘খাকসার আলী জৌনপুরী’। ইতিহাস সাক্ষী পরবর্তীতে তাঁর অলৌকিক ঘটনা এবং অসংখ্য
কারামাত দেখে লোকসমাজ তাঁকে মুহাম্মাদ আলীর পরিবর্তে কারামাত আলী নামে ডাকতো । আজ
সে এ নামেই সর্বজনস্বীকৃত এবং পৃথিবীর লোক সমাজের কাছে পরিচিত । তাঁকে হাদিয়ে
বাঙ্গাল উপাধি ও দেয়া হয়।
হযরত শাহ্ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) তাঁর
পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন এবং পরবর্তীতে মাওলানা কুদরতুল্লাহ রুদলবী ও
আহমাদুল্লাহ আল্লামীর নিকট পবিত্র হাদিস শিক্ষা লাভ করেন ।
আঠারো বছর বয়সে ১৮১৯ সালে পিতার অনুমতি নিয়ে এলমে
তাসাউফ শাস্ত্রে আগ্রহী হয়ে তৎকালীন সময়ে ভারতের রায়বেরেলিতে বিখ্যাত অলী-আল্লাহ,
ধর্মীয় সংস্কারক এবং "নবী মুহাম্মদের পথ" (তারিকাহ মুহাম্মাদিয়াহ),
নামে একটি তরীকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভী (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ
করে তাঁর নিকট নকশেবন্দীয়া তরিকার বায়াত গ্রহন করেন ।
আধ্যাত্বিকতার শিক্ষা ছাড়াও তিনি ‘ইলমে মাকুলাত’
ও ‘ইলমে মানকুলাত’-এর শিক্ষা নিয়েছেন দেশ-বিদেশের সেরা সূফী সাধকদের কাছে। নিজেকে
জাগতিক ও আধ্যাত্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন।
হযরত শাহ্ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) কাদিরীয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দদিয়া
এবং মুহাম্মদীয়া তরীকায় দিক্ষা লাভ করেছিলেন।
শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই নয়। ধর্মীয় জ্ঞানের
পাশাপাশি দর্শন, বিজ্ঞান, তর্ক বিদ্যায়ও তিনি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। এসব
বিষয়ে যেমন বিভিন্ন পন্ডিতের কাছে জ্ঞান চর্চা করেছেন, তেমনি অধ্যয়ন করেছেন এসব
জ্ঞানের ওপর বিভিন্ন তত্ত্বীয় কিতাব।
আরবী ও ফারসী ভাষায় লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না।
তিনি এত ভাল লিখতে পারতেন যে, এ নিয়ে অনেক সুনাম রয়েছে তাঁর। ইসলামী বিশ্বকোষে
বলা হয়েছে-একটি ধানের ওপর বিসমিল্লাহ্ সহ সূরা ইখলাস লিখে, সেখানে নিজের নামও
লিখতে পারতেন। অবশ্য এটা কেবল তাঁর লিপি-কৌশলই ছিল না, ছিল কারামতও বটে। তিনি সাত
ধরণের লেখা লিখতে পারতেন। এক কথায় হস্তলিপি-কলায় তিনি ছিলেন অসাধারণ। বিশেষ করে
তাঁর কালে এদেশে কুফিক, নাসতালিক ও ফারসী লিপি কৌশলে তাঁর মত পারদর্শী খুব কমই
ছিলেন। তিনি লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন হাফিজ আবদুল গনী
সাহেবের কাছ থেকে।
শিখদের সাথে বালাকোট যুদ্ধ এবং ১৮৫৭ সালের
সিপাহী বিপ্লবে সশ্বরীরে অংশ গ্রহণে তাঁর মুর্শিদ হযরত সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভী
(রহ.) তাঁকে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘তুমি বাকযুদ্ধে লিপ্ত হও, জনসাধারণকে
হিদায়াত কর। এটা অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’ তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের বদলে
বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ওয়াজ-নসীহত ও লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও তারিকাহ
মুহাম্মাদিয়াহ প্রচারের জন্য বাংলা ও আসাম নির্দেশ দেন। কারণ তৎকালীন সময়ে এসব
অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের নিয়ম-কানুন পালন বন্ধ করে তখন হিন্দুয়ানী
প্রথা অনেককাংশে চালু হয়ে গিয়েছিল বাংলার মুসলমানদের মাঝে। ইসলামী পোশাকের বদলে,
হিন্দুয়ানী পোষাক পরার চল শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে শাদীতেও হিন্দুয়ানী রীতি।
এমনকি হিন্দুয়ানী নাম রাখার চলও শুরু হয়ে যায়। মুসলিম রমণীদের মাঝে পর্দা
প্রথার বিশেষ কোন বালাই ছিল না। এক কথায় বাংলায় তখন ইসলামের ঘোর দুর্দিন
চলছিল।
স্বীয় মুর্শিদের নির্দেশে হযরত শাহ্ কারামত আলী
জৈনপুরী (রহ.) বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের কাজে
লিপ্ত হন। তিনি কলকাতা থেকে প্রথম আসেন যশোর। তারপর খুলনা এবং পুরো বাংলা। এ পুরো
সফরই কাটে বজরায় (বড় নৌকা) করে।
বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে হযরত শাহ্ কারামত আলী
জৈনপুরী (রহ.) তাঁর গ্রন্থ ‘মুরাদুল মুরীদীন’-এ লিখেছেন- ‘এই ফকীরের অবস্থা ছিল
যে, হিন্দুস্থান হতে কলকাতা, চট্টগ্রাম ও সন্দীপ পর্যন্ত এবং ঢাকা হতে সিলেট
পর্যন্ত যে সমস্ত শহর ও গ্রাম পূর্ব বাংলায় আছে, তা হামেশা সফর করতে হতো এবং
ইসলামের হিফাযতের চেষ্টা করতে হতো।’
তারিকাহ মুহাম্মাদিয়াহ প্রচার এবং সমাজের ধর্মীয়
কু-সংস্কারগুলো সংস্কারের মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি মানুষ ইসলামের ছায়াতলে
এসেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে যার প্রমাণ যায়- বিখ্যাত ইংরেজ লেখক William Hunter এর
লিখিত "The Indian Muslims" বইতে স্পষ্ট লিখা আছে; ১৮৭১-১৮৯১ সাল
পর্যন্ত একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ২০% করে মুসলমান বৃদ্ধি পেয়েছে ।
ভারতবর্ষের পশ্চিমান্তে যেখানে হিন্দু ছিল ৭০% আর মুসলিম ছিল ৩০%, সেখানে দ্রুত
সময়ে মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে হয় ৭০% আর হিন্দুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০% । তাই মুসলিম
সংখ্যাধিক্যের কারণে দেশ বিভক্তির পর বৃটেন থেকে ইংরেজ গভর্নরকে শোকজ করা হয়,
মুসলমানদের সংখ্যা রাতারাতি পাল্টে যাওয়ার পিছনে কি কারণ ?? প্রদেশের ইংরেজ গভর্নর
জরিপ করে রিপোর্ট প্রেরণ করল যে, এর পিছনে একটি মাত্র ব্যক্তি কাজ করছেন । তিনি হলেন
হাদীয়ে বাঙ্গাল শাহ্ কারামাত আলী জৈনপুরী (রহ.) । যিনি ভারতের উত্তর প্রদেশ জৈনপুর
হতে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল বিধ্বস্ত ঢেউকে পারী দিয়ে সুদীর্ঘকাল গ্রামে গঞ্জে,
মাঠেঘাটে, নদীর বাঁকে বাঁকে দ্বীন ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অবিস্বরণীয় অবদান রাখেন
। যার কারণে তাদের এত পরিশ্রম ব্যর্থ।
আবার সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) তাঁর
বিখ্যাত কিতাব "তারিখে দাওয়াত ও আজিমাতের" মধ্যে লিখেনঃ- “আব্দুল কাদির
জিলানী (রহ.)-এর হাতে ৮০ হাজার লোক মুসলমান হয়েছে । খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)-এর
হাতে ৯০ লক্ষ লোক মুসলমান হয়েছে । আর হাদীয়ে বাঙ্গাল হযরত শাহ্ কারামাত আলী
জৈনপুরী (রহ.) এর হাতে সরাসরি এক কোটি লোক মুসলমান হয়েছে” ।
হযরত শাহ্ কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.) প্রায়
৪৬টি পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে মাত্র ১৯ টি পুস্তক তিন খন্ডে যখীরায়ে কারামত
নামে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের বহু স্থানে সুদীর্ঘ একান্ন বছর
ধরে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম সংস্কার মূলক কার্যাদি সুসম্পন্ন করার পর অবশেষে ১২৯০
হিজরীতে রংপুর শহরে আগমন করেন এবং এই শহরের মুন্সিপাড়া নামক স্থানে দাওয়াতের কাজে
অবস্থান করেন । এখানে তিনি ১২৯০ হিজরির ২রা রবিউস সানী মোতাবেক ১৮৭৩ সালের ৩০শে মে
এই মহামানব ওফাত লাভ করেন। রংপুর জেলার কেরামতিয়া মসজিদ প্রাঙ্গণে চির নিদ্রায়
শায়িত আছেন।
0 Comments