
হযরত খানজাহান আলী
(রহ.) একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক ছিলেন।
মাজারের শিলালিপিতে তাঁর নাম আযম খানজাহান” ও ”উলুঘ খানহাজান”লেখা আছে।
হযরত খানজাহান আলী (রহ.) ১৩৬৯ সালে দিল্লীতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন।
তাঁর পিতার নাম আকবর
খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি। তাঁর পুর্বপুরুষগণ তুরষ্কের অধিবাসী ছিলেন।
খানজাহান আলীর প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা
গ্রহণ করেন দিল্লীস্থ বিখ্যাত ওয়ালি এ কামিল পীর হযরত শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.)
এর কাছে। তিনি কুরআন, হাদীস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন
করেন।
হযরত খানজাহান আলী
(রহ.) ১৩৮৯ সালে তুঘলক সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প
সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন।
১৩৯৪ সালে মাত্র
২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্ণর) পদে যোগ দেন।
জৈনপুরের সুলতান
ইবরাহিম শর্কির কাছে বাংলার ইসলাম রক্ষা ও প্রচারের জন্য নুর-ই কুতুব-উল আলম নামের
এক ইসলামিক ব্যক্তিত্ব ৬০ হাজার সৈন্য চান। নুর-ই কুতুব-উল আলমের কথা মতো সুলতান
ইবরাহিম শর্কি ৬০ হাজার সৈন্যবাহিনী পাঠান। ওই সৈন্যবাহিনী পরিচালনায় প্রধান
সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ খ্যাত হজরত খানজাহান
আলী (রহ.)।
সুলতান ইবরাহিম শর্কির
অনুমতি ক্রমে হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) সহ যে ১১ জন ব্যক্তি এসেছিল ( তারা সবাই ছিলেন
জ্ঞানী ও ইলমে মারেফাতের বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী ) এবং সুসজ্জিত ৬০ হাজার সৈন্যের বহর নিয়ে গনেশের
রাজধানী গৌড় অতিক্রম করে বাংলায় এসে পৌছেন।
হজরত খানজাহান আলী (রহ.) ছিলেন তাদের অন্যতম। সে কারণেই তাকে এতবড় গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক মতে, ১৪১২-১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ঝিনাইদাহে এই ১২ জন ধর্মীয় ব্যক্তির নামে এলাকার নামকরন হয় বারো বাজার।
হজরত খানজাহান আলী (রহ.)
বারোবাজারে অবস্থানকালে রাজা গনেশ তার এক সুসজ্জিত প্রশিক্ষিত সৈন্যদলকে
বাধা প্রদানের জন্য পাঠায়। কিন্তু তারা বারো বাজারের অদুরে বিজয়পুর নামক স্থানে
পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন। পালিয়ে
যাওয়া এসব সৈন্যরা পরবতীর্তে বিভিন্ন সময় হজরত খানজাহানের ধর্ম প্রচারে বাধা
সৃষ্টি করে আসছিল।
বারোবাজারে
অবস্থানকালীন সময়ে হযরত খানজাহান আলী (রহ.) সেখানে জনকল্যানে তিনি দিঘি খনন ও মসজিদ নির্মান
করেন। পরে হজরত খানজাহান আলী (রহ.) তার এক শিষ্য রেবাস শাহ’র কাছে বারোবাজারের
দায়িত্বভার ও ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পন করেন।
হজরত খানজাহান আলী
(রাহ.) ধর্মপ্রচারের জন্য ভৈরব নদীর উপকূল ধরে মুরালী এলাকায় অগ্রসর হন। সেখানে
সৈন্যদের নিয়ে ঘাটি গাড়েন। অনুসারীদের সাথে নিয়ে দিঘি, মসজিদ নির্মান করে ওই
অঞ্চলকে পর্যায়ক্রমে শহর গড়ে তোলেন।
ওই সময় বৌদ্ধদের
মুরালী নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুরালী কসবা। এই মুরালী কসবা শহরের অদুরে তিনি
আরেকটি শহর গড়ে তোলেন যার নাম দেন ‘ছানি কসবা’। যা পরবর্তীকালে পুরাতন কসবা নামে
পরিচিত ছিল। এই পুরাতন কসবাই বর্তমান যশোর জেলা।
হজরত খানজাহান আলী (রহ.)
তার দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব গরিব শাহ ও বোরহান শাহ এর উপর ওই এলাকার দায়িত্ব ভার
অর্পন করে বর্তমান মেহেরপুর পূর্বের পায়গ্রামে ঘাটি গাড়েন।
পায়গ্রাম কসবায়
কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি মির্জাপুর ও গোপালপুরে কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
কিছুদিন পরে তার প্রিয় শিষ্য মেহেরউদ্দীন খানকে সেখানে রেখে আবারও দক্ষিণের দিকে
অগ্রসর হন। মেহের উদ্দীন পীরের নাম অনুসারে পওে ওই স্থানের নাম হয় মেহেরপুর।
মেহেরপুরে ওই সময়ে
অনেক হিন্দু ব্রাহ্মণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যার মধ্যে গোবিন্দ ঠাকুর অন্যতম।
হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তার খুব প্রভাব ছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর তার নাম রাখা
হয় মোহাম্মদ আবু তাহের।
শেষ জীবন পর্যন্ত গোবিন্দ ঠাকুর বা মোহাম্মদ আবু
তাহের হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) সহচার্যে থেকে তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্য (যশোর, খুলনা,
বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও রবিশালের কিছু অংশ) খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর
দায়িত্ব পালন করেন।
খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রশাসনিক
কেন্দ্র ছিল বর্তমান বাগেরহাট জেলার ষাটগুম্বুজ
মসজিদ। এ মসজিদ থেকেই ফলিফাতাবাদ রাজ্য পরিচালনা করা হতো। হজরত খানজাহান আলী প্রতিষ্ঠিত
রাজ্যটি তিনটি পরগনায় বিভক্ত ছিল। যা যশোর, বেতকাশী ও বাগেরহাট নামে পরিচিত ছিল। এ
রাজ্যের প্রশাসনিক রাজধানী বা দফরত ছিল বাগেরহাটের হাবেলী খলিফাতাবাদ পরগনায়।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) প্রতিষ্ঠিত ষাটগুম্বুজ মসজিদ, বাসস্থান, প্রশাসনিক অঞ্চলসহ
অন্যান্য স্থাপনাগুলো পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২.৫ (আড়াই) কিলোমিটার জায়গাজুড়ে
অবস্থিত।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) রাজা গনেশের সুশিক্ষিত
পলাতক সেনাবাহিনীর ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতেন।বর্তমান বাগেরহাট ছিল
সুন্দরবনের খাদি অঞ্চলের সমতটভুমি। এখানে মগ মূর্তিপূজক, তান্তিক ও জলদস্যুরা
আবাসস্থল গড়ে তুলেছিল। রাজা গনেশের পলাতক সৈন্যদল ও এই সমতটভুমিতে আবাসস্থল গড়ে
তোলা তান্তিক ও জলদস্যুদের সাথে নিয়ে হজরত খানজাহান আলীর (রাহ.) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত
হওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে।
এমনকি এ অঞ্চলের মগরাজ কর্নওয়ালি তার হস্তি বাহিনী
দিয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) এ সংবাদ
পেয়ে সৈন্যবাহিনী নিয়ে পায়গ্রাম কসবা বা মেহেরপুর থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা
দেন।
মেহেরপুরের পায়গ্রাম কসবা থেকে খুলনার সেনের বাজার,
সামান্তসেনা, রাংদিয়া, পিলজং হয়ে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে অনেককে পরাজিত করে বাগেরহাটের
ষাটগুম্বুজ এসে পৌছেন। এ যাত্রা পথে তার অনেক সঙ্গী শহাদাতবরণ করেন।
হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলিম হওয়া মোহাম্মদ আবু তাহেরের
সাথে আনেক ব্রাহ্মণও ওই যুদ্ধে হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) পক্ষে অংশ নিয়ে মারা যায়।
হজরত খানজাহান আলী (রাহ.) যুদ্ধে জয়ী হয়ে পরে তিনি
বারাকপুরে ছাউনি ফেলে বাদোখালী বিল অতিক্রম করে সুন্দরঘোনা গ্রামে এসে উপস্থিত হন।
বারাকপুর ও সুন্দরঘোনা পাশাপাশি গ্রাম। বারাকপুরে পাকা রাস্তা ও শিবির স্থাপন করার
পর সুন্দরঘোনা গ্রামে বিশাল দিঘী খনন করেন। যা ঘোড়া দিঘি নামে পরিচিত।
এই ঘোড়া দিঘীর অদুরে উত্তর দিকে হজরত খানজাহান আলী (রহ.) এর বসতভিটা। আর ঘোড়া দিঘীর পূর্ব পাড়েই তিনি তার শিবির পুনরায় স্থানাস্তর করেনতৈরী করেন ঐতিহাসিক ষাটগুম্বুজ মসজিদ। প্রতিষ্ঠা করেন খলিফাতাবাদ রাজ্য।
হযরত খানজাহান আলী
(রহ.) তাঁর স্বীয় মোর্শেদ হযরত নুর-কুতুবুল আলম (রহ.) এর একমাত্র কন্যা সোনা বিবিকে বিবাহ করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রূপা বিবি ওরফে বিবি বেগনি ধর্মান্তরিত
মুসলমান ছিলেন। হযরত খানজাহান আলী (রহ.) তাঁর দুই স্ত্রীর নাম অনুসারে সোনা মসজিদএবং বিবি বেগনি মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন।
হযরত খানজাহান আলী
(রহ.) এমন এক মহাপুরুষ ছিলেন যাঁর মহতী গুনাবলীর দ্বারা বাগেরহাটসহ সমগ্র ভাটিঅঞ্চল উপকৃত ও ধন্য হয়েছে। কথিত আছে এ মহাপুরুষ মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে
যশোরের বারো বাজার থেকে শুরু করে সমগ্র ভাটি অঞ্চল জুড়ে ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ ও ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিলেন। বাগেরহাটে নির্মাণ করেন স্বরণকালের বিখ্যাত মসজিদ ষাট
গম্বুজ মসজিদ।
মুসলমানদের প্রথম আবাদকৃত এ অঞ্চলে উপাসনার জন্য মসজিদগুলি এবং নোনা পানির দেশ ভাটি অঞ্চলে সুপেয় পানীয় জলের এ দীঘিগুলি আপামর জনগণের কাছে খোদার আশীর্বাদের মতই প্রতিভাত হয়েছিল। হযরত খানজাহান আলী (রহ.) অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯ তারিখে (মাজার শরিফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরি ২৬শে জিলহজ্ব) ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে ওফাত লাভ করেন। ষাটগম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গনেই তাঁর রওজা শরীফ আছে।
0 Comments