Header Ads Widget

হজরত বাবা আদম শহীদ (রহ.)

  


হজরত বাবা আদম শহীদ (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র আরব দেশের তায়েফ নগরীতে। তিনি কত সালে জন্মগ্রহণ করেন এ ব্যাপারে লেখক কিছু জানাতে পারেনি। তবে ১০৯৯ সালে জেরুজালেম ক্রসডে তার বাবা শহীদ হন এবং পক্ষকাল পরে বাবা আদম জন্মগ্রহণ করেন। খোরসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম (রহ.) উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর বাবা আদম (রহ.) আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর সাহচর্যে আসেন এবং তাসাউফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন।

 

হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.) ১১৪২ খিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান। “প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাব এবং বাবা আদম শহীদ (রহ.)” গ্রন্থের লেখক মুজিবর রহমান মাখন উল্লেখ করেছেন, মুর্শিদের (বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির) আদেশে প্রাচীন ভারতবর্ষে আসেন ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে। ১১৪২ সালেই তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন এবং সেখান থেকে ১১৫২ সালে আসেন মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে।


 

শাহ হুমায়ুন কবির "The Battle of Kanai Changue" গ্রন্থে বলেন, হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.) প্রথমে মহাস্থানগড়ের দরগাহ বাড়িতে ১১৭৩ সালে “খানকায়ে কাদেরিয়া” স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তিনি মুন্সীগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে আরও তিনটি খানকা নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন। এ তিনটি খানকায় যথাক্রমে সৈয়দ জোবায়ের (রহ.), শহীদ মুয়াবিয়ান আল বসরি (রহ.)ও শেখ মখদুম আল মুয়াসসিস (রহ.)  দায়িত্ব দেন।

 

হজরত বাবা আদম (রহ.) ১১৪২ সালে মুর্শিদের আদেশে প্রথমে মহাস্থানগড়ে এসে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তার সফরসঙ্গী ১২ জন আউলিয়ার অধীনে ১২টি মিশন গঠন করে এলাকায় পানির অভাব দূর করতে পুকুর খনন, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ জন ওলি বাবা আদমের নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। বিক্রমপুর, মহাস্থানগড়, চট্টগ্রাম, নাঙ্গলকোট, বাঙ্গাল, দেবকোট, ইন্দ্রপস্ত, প্রয়াগ, পাটুলীপুত্র, নাগপুর, দাক্ষিণাত্য বর্তমানে পু-বর্ধন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। ১২ জন অলির মধ্যে ৫ জনের মাজার মুন্সীগঞ্জে অবস্থিত। তাঁরা হলেন :

১. শেখ মখদুম আলমুয়াসসিস (রহ.) মাজার দরগাহ বাড়ী, মুন্সীগঞ্জ,

২. আযৃযায়িরা বিন সাঈদ (রহ.), ধীপুর, মুন্সীগঞ্জ,

৩. খুবরাত ইবনে মুদাককিক (রহ.) মাজার মুন্সীগঞ্জ,

৪. ইমামুদ্দীন বাগদাদী (রহ.) মাজার মুন্সীগঞ্জ,

৫. মুষাব্রীয়ান আলবসরী (রহ.) মুন্সীগঞ্জ।


এছাড়াও হজরত বাবা আদম (রহ.)-এর কয়েকজন বিখ্যাত খলিফা বিক্রমপুরে (মুন্সীগঞ্জ) কয়েকটি মিশন পরিচালনা করতেন। এদের মধ্য কেওয়ার ও রাম গোপালপুর ১১৫২-তে ইসলাম প্রচার করেন।তাদের নামের মাজার শনাক্ত করা যায়নি।

 


তখন বাংলায় সেন শাসন আমল চলছিল। এলাকাটি ছিল বল্লাল সেনের অধীনে। জনশ্রুতি আছে যে, বিক্রমপুরের মহাপরাক্রমশালী রাজা বল্লাল সেন ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক। তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে মসজিদ গুলোকে মন্দিরে পরিণত করেন এবং বিক্রমপুরে গরু জবেহ ও আযান দিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করেন।

রামপালের নিকটস্থ আব্দুল্লাহপুর গ্রামের কানাইচং মাঠের জনৈক মুসলমান তার পুত্রের জন্ম উপলক্ষে অতি সঙ্গোপনে গরু জবেহ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একটি চিল ছো মেরে এক টুকরো মাংস নিয়ে বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায় ফেলে। ফলে বল্লাল সেন অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে গো হত্যাকরীকে খোঁজে বের করার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করেন।

 

এই খবর হযরত বাবা আদম (রহ.) এর কাছে পৌছে এবং তিনি বল্লাল সেনের অত্যাচার থেকে মুসলিম পরিবারকে রক্ষার জন্য বল্লাল সেনের রাজধানী রামপালের উপকন্ঠে দরগাবাড়িতে এসে ঘাঁটি গাড়েন।  এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের নামে মসজিদটি নামকরণ করেন বাবা আদমের মসজিদ। এই মসজিদটিকে কেন্দ্র করেই বাব আদম ইসলামী আচার অনুষ্ঠান প্রকাশ্যেই পালন করা শুরু করেন। আজান দিয়ে নামাজ পড়া শুরু হয়। এই আজানের শব্দ বল্লাল সেনের রাজপ্রসাদের অভ্যন্তর ভাগেও গিয়ে পৌঁছে। এতে বল্লাল ক্ষুদ্ধ হয়ে নবাগত মুসলিম সৈন্যবাহিনীর নেতা বাবা আদমের কাছে কয়েকটি দাবী রেখে দূত পাঠান। দূত এসে বাবা আদমকে বলেন, “হয় বিক্রমপুর ছেড়ে চলে যাও নয় পৌত্তলিকতা বিরোধী আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন থেকে বিরত হও।”

কিন্তু অলৈকিক ক্ষমতাসম্পন্ন আল্লাহর বন্ধু হযরত বাবা আদম (রহ.) এতে দমাবার পত্র নন। তিনি তার অসংখ্য ভক্তের সমর্থনে নিশ্চিত হয়ে পরাক্রমশালী বল্লাল সেনের কাছে এক ঔদ্ধত্বপূর্ণ উত্তর পাঠালেন। তিনি বললেন, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তার রসূল। পৌত্তলিক বল্লাল রাজা যাই বলুন না কেন আর যাই করুন না কেন আমি এবং আমার সমর্থন আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন থেকে এক চুল পরিমাণও বিরত হব না”। 

এহেন কঠোর উত্তরে রাগান্বিত হয়ে বল্লাল সেন সৈন্য সংগ্রহ করে বাবা আদমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করলেন।

কারও কারও মতে, হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.) ১১৭৪ সালে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) এর ওফাত বার্ষিকীতে টঙ্গীবাড়ির আবদুল্লাহপুরে গরু জবাই করে “ফাতেহায়ে ইয়াযদাহুম” এবং “গেয়ারভী শরীফ” পালন করেন। গরু জবাই করা হলে বল্লাল সেন রাগে খানকার দায়িত্বে নিয়োজিত মুয়াবিয়ান আল বসরিকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে শহীদ করেন। এতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে থাকা সুফিরা বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

আবার কারও কারও মতে, ইসলাম প্রচারের সময় রাজা বল্লাল সেনের রাজকর্মচারীদের সঙ্গে সুফি শেখ মখদুম আল মুয়াসসিসের বিরোধ সৃষ্টি হয়। রাজা বল্লাল সেন তাঁকে টঙ্গীবাড়ী ধীপুর থেকে কারারুদ্ধ করেন। এ খবর শুনে হযরত বাবা আদম (রহ.) মহাস্থানগড় থেকে বিক্রিমপুর আসেন। কারাগারে শেখ মুখদুমকে দেখে তাঁর অনুপম চরিত্র ও ইবাদত-বন্দেগীতে আকৃষ্ঠ হয়ে বল্লাল সেনের ভাগ্নে অজয় সেনের একমাত্র কন্যা মাধুরী সেন ইসলাম গ্রহণ করেন শুনে রাজা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

যাই হোক, এক বা একাধিক কারণে রাজা বল্লাল সেন এবং হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মধ্যকার যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে।

 

 

সে ধর্মযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.)। এভাবে কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ- যুদ্ধ ও হয়েছিল বাবা আদমের (রহ.) সঙ্গে বল্লাল সেনের। কথিত আছে, ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে মুন্সীগঞ্জে কানাইচং ময়দানে ১০ দিনব্যাপী যুদ্ধে বহু সংখ্যক সৈন্য ও মুজাহিদ নিহত হন। এ যুদ্ধে বল্লাল সেনের সৈন্য ছিল ২০ হাজার, অপরদিকে মুজাহিদ ও সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার।

 

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রাজা বল্লাল সেন যুদ্ধে যাবার আগেই মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়ে যাতে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে মানসম্ভ্রম খোয়াতে না হয় সে জন্য তার পরিবাবের সকল সদস্যকে বলেন- তিনি সাথে করে একটি কবুতর নিয়ে যাবেন  এবং বলে যান যে, পায়রাটি একা রাজপুরীতে ফিরে এলে রানী এবং রাজপরিবারের অপরাপর সদস্যগণ যেন মনে করেন যে রাজা যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছেন। আর তারাও যেন জাতিধর্ম রক্ষার জন্য অমনি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন দেন।

 

এই উদ্দেশ্যে পূর্ব থেকেই রাজপুরীতে একটি অগ্নিকুন্ড প্রজ্বলিত ছিল। রাজধানী রামপালের মাইল দুই দূরবর্তী কানাইচঙ্গের মাঠে প্রত্যুষকালে থেকে তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পরাজয়ের আশংকায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করলে হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.) সরল বিশ্বাসে মেনে নেন।

কিন্তু সেদিন রাতে ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। বিক্রমপুরের দরগাহ বাড়িতে এশার নামাজের পর বাবা আদম (রহ.) মোরাকাবা থাকা অবস্থায় বল্লাল সেন তার তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করে। বাবা আদম (রহ.) শহীদ হওয়ার পর রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।

 

এদিকে বল্লাল সেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে রক্তমাখা দেহ ধোয়ার  জন্য যেই পার্শ্ববর্তী জলাশয় “কাঁছারীর দীধিতে” অবতরণ করেন অমনি দৈবক্রমে পায়রাটি বস্ত্রাভ্যন্তরে থেকে উড়ে গিয়ে রাজপুরীতে পৌঁছে। আর তক্ষুণি রাণী ও রাজপরিবারের অপরাপর সদস্যবৃন্দ ও রাজার পরাজয় ও মৃত্যু আশঙ্কা করে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন দেন।

 

এদিকে বল্লাল সেনও পায়রা ছুটে যাওয়া মাত্রই যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পাগলের মতো রাজধানী রামপাল অভিমুখে ছুটে এলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে সবাই শেষ হয়ে গেছে। এই শোক সহ্য করতে না পেরে রাজ নিজেও ঐ একই চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহুতি দেন।রাজ পরিবারের মৃত্যুর পর বিক্রমপুর মুসলমানদের দখলে চলে আসে।

 

 ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুরশাহ বাবা আদমের খানকার ওপর একটি চমৎকার মসজিদ  নির্মাণ করেন। মসজিদটির ৬ গম্বুজ পুরাকালের আত্মত্যাগী বাবা আদমের কথা মনে করিয়ে দেয়।

Post a Comment

0 Comments