হযরত শাহ্ খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.)- হযরত শাহ্ খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.) , হযরত শাহ্ খাজা শরফুদ্দিন চিশতী (রহ.) সুলতানুল হিন্দ, খাজা গরীব উন নওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন হাসান চিশতী (রহ.) এর ২য় পুত্র ছিলেন।
হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) এর ২য় স্ত্রী হযরত বিবি ইসমত এর গর্ভে
ও হযরত শাহ্ খাজা মঈনুদ্দিন
চিশতী (রহ.) এর ঔরষে তিনি ৬২৮ হিজরী
মোতাবেক ১২৩০ খৃষ্টাব্দে
আজমীর শরীফে জম্ম গ্রহণ করেন। তাঁর
প্রকৃত নাম ছিল হযরত
খাজা হুসাম উদ্দিন
আবু সালেহ চিশতী (রহ.) ।
পরবর্তী কিশোর বয়সে তিনি দিল্লীতে হযরত নিজাম
উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর হাতে বায়াত
হন ও তার কাছে ইলমে মারেফাতে জ্ঞান অর্জন করেন। ক্রমে তিনি কঠোর সাধনা দ্বারা কামালিয়াতের
উচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের
আবদালে পরিণত হন।
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী
(রহ.) এর ওফাতের পর আজমীর শরীফ পূনরায়
এর অভূতপূর্ব হিন্দু
রাজা পৃথিরাজ রায় এর পুত্রগনের
দখলে চলে যায় ও আজমীর
শরীফের মুসলমান গণ নির্যাতনের শিকার হন।
এ সময়
৬৬৩ হিজরী মোতাবেক
১২৬৫ সালে তাঁর বড়
ভাই হযরত খাজা ফখর উদ্দিন আরুল খাইর চিশতী
(রহ.) হিন্দু দুস্কৃতকারীদের সাথে যুদ্ধে শাহাদত
বরণ করেন। এতে তিনি খুবই মর্মাহত হন ও আজমীর শরীফ ত্যাগ
করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এ সময় তার বয়স ছিল ৪৫ বৎসর । এ সময় একদা রাতে তিনি পিতা হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) এর নিকট থেকে বাশারত লাভ করেন
ও পূর্বদিকে দেশে গমন করে দ্বীনের খেদমত করার নির্দ্দেশ
লাভ করেন। এই অবস্থায় কাউকে কিছু না জানিয়ে একদা
গভীর রাতে পদব্রজে
দিল্লীর উদ্দেশ্যে আজমীর শরীফ করেন।
এই
একই সময়ের কিছু পূর্বে
হযরত শাহ্ জালাল
(রহ.) বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে
দিল্লীর হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া
(রহ.) কতৃক নির্দেশিত
হয়ে ১২ জন আউলিয়া সহযোগে
বঙ্গেদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথিমধ্যে
বিভিন্ন স্থানে আরও বহু আউলিয়া
দরবেশ তার সঙ্গী
হন।
হযরত
শাহ্ খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.) আজমীর শরীফ থেকে পদব্রজে দিল্লী
আসেন এবং সেখানে
সংবাদ পান যে, হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) ১২ জন সঙ্গী সহ পূর্ব
দিকে বঙ্গদেশের উদ্দেশ্যে
রওনা হয়েছেন এবং বর্তমানে
সমরখন্দে অবস্থান করছেন, হযরত শাহ্ খাজা শরফুউদ্দিন
চিশতী (রহ.) পদব্রজে সমরখন্দে
গিয়ে তার সাথে যোগ
দেন।
আজমির শরীফ হতে মুহাম্মদ
শরীফ নামে অপর এক অলী আল্লাহ
একই সময়ে হযরত শাহ্ জালাল (রহ.)
এর সাথে যোগ দেন। হযরত শাহ্ জালাল (রহ.)
এর এই কাফেলার
সাথে হযরত হুশাম উদ্দিন
মূলতান, ইরান, আফগানিস্তান, বিহার,
প্রভৃতি দেশ পদব্রজে
পেরিয়ে বঙ্গদেশের সপ্তগ্রামে
এসে উপস্থিত হন।
সপ্তগ্রাম
তখন
ছিল মুসলিম সুলতান
শামস্ উদ্দীন ফিরোজ শাহ্ এর রাজ্য
লাখনৌতির অন্তগত ।
শ্রীহট্র
(সিলেট) তখন ছিলো অত্যাচারী
হিন্দু রাজা গোবিন্দ
এর অধিনে । সুলতান
সামস্ উদ্দিনকে শ্রীহট্র
অভিযানে উপদেশ দিয়ে হযরত শাহ জালাল
(রহ.) সুলতানের সেনাবাহিনীর সিপাহশালার
হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহ.) এর বাহিনীর
সাথে হযরত শাহ্ খাজা শরফুউদ্দিন
চিশতী (রহ.) ও হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর ৩৬০ জন
ওলী দরবেশ হিজরী ৭০১
মোতাবেক ১৩০৩ সালে বিজয়ীর বেশে শ্রীহট্রে প্রবেশ
করেন। অতপর শ্রীহট্র বা সিলেট হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর সাথে তিনি ২ বৎসর
অবস্থান করেন ও তার সহবতে ফায়েজ
ও বরকত লাভ করেন।
এই সময় খাজা গরীব উন নওয়াজ (রহ.) এর পুত্র হিসাবে পরিচিতি
প্রকাশ পেলে হযরত শাহ জালাল (রহ.)
তার নাম রাখলেন
শরফ উদ্দিন যার আরবী অর্থ হচ্ছে
বদলানো বা পাল্টানো।
সেই থেকেই হযরত শাহ্
খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.) হযরত খাজা শরফ উদ্দিন চিশতী
(রহ.) নামে পরিচিত হন ।
হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর জীবনী
গ্রন্থ সমূহে তার সঙ্গী ৩৬০
জন আউলিয়ার নামের তালিকায় তার নাম এবং সাথী মোঃ শরীফ
ওরফে শরীফ আজমেরী
এর নাম অন্তভূক্ত
আছে ।
অতপর ৭০৩ হিজরী মোতাবেক
১৩০৫ সালে তিনি হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর নির্দেশে
দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে
শ্রীহট্র থেকে দক্ষিণ
বঙ্গের দিকে নৌকা যোগে রওয়ানা
হন। পথিমধ্যে সোনারগাঁও
এ অবস্থিত "হযরত শরফ উদ্দিন
আবু তাওয়ামা" প্রতিষ্ঠিত খানকা শরীফে কিছু কাল অবস্থান
কালে কিছু সূফী সাধকদের পরামর্শে
রমনা নামক এক গ্রামে
অবস্থিত এক কালী মন্দিরের পাশে বসবাসকারী জনগণের
নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে ইচ্ছুক
হয়ে তিনি ঐ এলাকার উদ্দেশ্যে
সোনারগাঁও থেকে নৌকা যোগে রওয়ানা
হন এবং তিনি উক্ত কালী মন্দিরের ( সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের
ভিতর এখনও দাঁড়িয়ে
আছে ) কাছাকাছি স্থানে আসার জন্য বুড়িগঙ্গা
নদীর সাথে সংযুক্ত
এক খাল পথের শেষপ্রান্তে
(
বর্তমানে এটি জাতীয় ঈদগাহ মাঠ) এসে এক গভীর কিন্তু
সরু এক পায়ে চলা পথের পাশে অবতরণ করেন।
স্থানটি
নির্জন লোকালয় শূন্য হওয়ায় তার খুব পছন্দ হয় ও এখানেই তিনি আস্তানা
প্রতিষ্ঠা করেন ( বর্তমানে এই স্থানে এই হাইকোর্ট
মাজার ও মসজিদ অবস্থিত)।
এখানে
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময় তথা খ্রীষ্টিয় দ্বাদশ শতাব্দিতে
রমণা গ্রামটি সংখ্যালঘু বৌদ্ধ
ধর্মাবলন্বী এবং হিন্দু
জনগণ দ্বারা অধিষ্ঠিত
ছিল। খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে
এখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলন্বীদের উপসানালয়
"গুরুদুয়ারা নানকশাহী" প্রতিষ্ঠিত
হয় । ১১০০ সালে নেপালের
বদ্রীনাথ যোশী মঠ' এর শংকরাচার্য
স্বামী গোলাপ গিরির নেতৃত্বে
একদল তীর্থ দর্শনার্থী
রমণা গ্রামে আগমন করে তথায় আস্তা
গড়ে তোলে এবং কালি মাতার
মন্দির প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি কাঠঘর মন্দির
নির্মাণ করেন, ও তথায় কালি পূজা শুরু হয়। ক্রমে ক্রমে এই কালিপূজার মন্দিরে
কাপালিকদের প্রাধান্য বিস্তৃত
হয় এবং তারা নরবলী যজ্ঞ সহ নানা যাগযজ্ঞ দ্বারা
স্থানীয় নিরীহ হিন্দু
ধর্মাবম্বী ও অপরাপর
বসবাকারীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেন। এই কাপালিদের
তান্ডবে সনাতন ধর্মের
সৌন্দর্য বিলীন হয়ে গেলে গৃহী হিন্দুরা বৌদ্ধ ও বামন্য
ধর্মের দিকে ধাবিত হতে থাকে ।
এই সময় এই এলাকায়
ছিল উৎকট তান্ত্রিক
হিন্দু গুরুবাদের প্রভাব এবং সূরাপায়ী তান্ত্রিকাবাদের এই পুরোহিতরা রমণার
কালি মন্দিরে উৎসর্গ
করত নরবলী । ভয়ে উৎকন্ঠায় এই গ্রামীন মানুষ গুলি যখন অস্থির ছিল ঠিক তখনই হিজরী ৭০৪ মোতাবেক ১৩০৬ সালে হযরত শাহ্
খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.) এই স্থানে
আস্তানা গড়ে তুলেন এবং
ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর চরিত্র মাধুর্য্য
ও শ্রদ্ধেয় পূর্ণাত্মার
পরিচয় পেয়ে হিন্দু
জনগণ অচিরেই তার প্রতি আকৃষ্ট
হতে থাকে এবং তাঁর
নিকট বায়াত হতে থাকে । নিজের জীবিকা নির্বাহের
দুঃশ্চিন্তা না করে তিনি এই অঞ্চলে ইসলামের
বানী প্রচার করতে থাকেন।
শত শত
হিন্দু তাঁর হাতে ইসলামের
শান্তি লাভ করে।
কিন্তু কায়েমী
স্বার্থবাদী পুরোহিতরা নানা ভাবে বাঁধার
সৃষ্টি করতে থাকে কিন্তু আল্লাহর বন্ধুর হযরত শাহ্
খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.) এর নিকট তান্ত্রিকদের
তন্ত্র মন্ত্র নিষ্ফল
হয় এবং এমন এক অবস্থার
সৃষ্টি হয় যে, কালি মন্দিরের
তান্ত্রিকেরা কিছু তাঁর নিকট ইসলামের ছায়া
সুশীতলে আশ্রয় নেয় বাকীরা
এই এলাকা
ছেড়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য
দেয় খ্রীষ্টিয় ত্রয়োদশ
শতকে এলাকার কালিমন্দিরটি
বিরান হয়ে যায় ও
তা বাদুর চামচিকার
আশ্রয় স্থানে পরিণত হয়
।
হযরত শাহ্ খাজা শরফুউদ্দিন চিশতী (রহ.) এর অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে মুসলিম লোকালয় গড়ে উঠে শত শত মানুষ ক্রমে ক্রমে তার সোহবতে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা ও ইসলাম প্রচারে তার কঠোর সাধনার কারণে তিনি ‘অলী-এ-বাংলা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। চিশতী পদবীর কারণে এলাকাটি “চিশতীয়া মহল্লা” নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
তিনি সুদীর্ঘ ৩৪ বৎসর এই এলাকায় অবস্থান করেন এবং হিজরী ৭৩৮ মোতাবেক ১৩৪০ সালে লী-এ-বাংলার ১১০ বৎসর বয়সে ওফাত লাভ করেন। তাঁর ভক্ত আশেকান ও মুরীদগন চিশতীয়া মহল্লার কবরস্থানের সন্নিকটে তাঁর হুজরার মধ্যে তাঁকে দাফন করেন। সেটাই আজ ওলী-এ-বাংলা হযরত শাহ্ খাজা শরফউদ্দিন চিশতী(রহ.) এর মাজার শরীফ ।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই এলাকায় চিশতীয়া মহল্লার বাড়ীঘর, মসজিদ ও কবরস্থান ছিল কিন্তু তাঁর ওফাতের পর পরবর্তীতে ৬০০বৎসর পর ১৯০৫ সালে এই স্থানে পূর্ব বাংলা প্রদেশের বড়লাটের বাসগৃহ নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে বৃটিশ সরকার এই এলাকার কবরস্থান নিশ্চিহ্ন করে গভর্নমেন্ট হাউস নির্মাণ করে, যা আজকের পুরাতন হাইকোট ভবন রূপে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ৩৫০ বছর পর ১৬১০ সালে যদিও ঢাকার শহর প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু এই ঢাকাতে ইসলাম ধর্মের গোড়া পত্তন করেন তিনি ১৩০০সালে ওলী-এ-বাংলা হযরত শাহ্ খাজা শরফউদ্দিন চিশতী (রহ.) এর জীবদ্দশাকালেই।
0 Comments