সিপাহসালার
হযরত সৈয়দ নাসিরুদ্দীন (রহ.) ১২৫০ সালে ইরাকের বাগদাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার
নাম পুরুষ হযরত সৈয়দ হাসান আরাবী (রহ.)। তিনি ছিলেন হযরত আলী (রা.) এর পুত্র হযরত
জয়নাল আবেদীন (রহ.) এর ৫ম তম অধস্থন বংশপুরুষ।
আব্বাসীয়
খেলাফতের শেষদিকে বাগদাদের রাজ পরিবারের নিষ্পেষণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে
স্বপরিবারে তিনি বাগাদাদ ত্যাগ করে ভারত আগমন করেন এবং এখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু
করেন। একসময় পরিবারের ব্যয় ভার নির্বাহের জন্য সৈয়দ নাসিরউদ্দীন (রহ.) দিল্লীর সুলতানের
অধীনে সৈনিক বিভাগে চাকুরী নেন। পরবর্তিতে সিপাহসালার পদে উন্বিত হয়ে দিল্লী হতে এ
দেশে আগমন করেন।
শ্রীহট্টের
গৌড় রাজ্যের অধিবাসী হযরত বুরহান উদ্দীন নামক জৈনক মুসলমান নিজ ছেলের জন্ম উৎসব উপলক্ষে
গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাবস্ত হন। ফলে গোবিন্দ
হযরত বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। হযরত বুরহান উদ্দীন বাংলার
তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে
রাজা তার ভাগিনে সিকান্দর গাজীকে প্রখণ্ড সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে
প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ
ভোতিক শক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নীবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল
করে ফেলে। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের
সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন।
পরবর্তিতে
সম্রাট তার রাজদরবারী আলেম-উলামা সহ জ্যোতিষদের সাথে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে,
সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তার নেতৃত্বে অভিযান
প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় সম্ভব
হবে। জ্যোতিষিরা উক্ত আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলে
ছিল, আগামী দুই/এক রাত্রের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রখণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে
যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির বিষম ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথায় কোন প্রদিপ থাকবেনা একটি মাত্র
তাবু ব্যতীত। সম্রাট জ্যোতিষদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে ফেলেন
এক জন সাধারণ সৈনিক একটি তাবুতে একাগ্র মনে বসে কোরান পড়ছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত
হয়ে তার সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান।
হযরত
সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) সম্রাটের আদেশে সম্মত হলে সম্রাট তাকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের
মাধ্যমে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। সে থেকে তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন হতে সিপাহসালার
হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) নামে খ্যাত হন।
১৩০৩
সালে সিপাহসালার পদে উন্নত হয়ে দিল্লী হতে বাংলাদেশে সিলেটাভিমূখে (শ্রীহট্টে) রাজা
গৌড় গোবিন্দের হাতে প্রতারির মুসলমানদের সহায়তায় প্রেরিত হন।
পথিমধ্যে
আরব হতে আগত প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর সাথে ত্রিবেণীতে দেখা হয়। সিপাহসালার
হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) হযরত শাহ জালাল (রহ.) সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁর বায়াত
গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
ত্রিবেণী
থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হযরত
হিসাম উদ্দীন, হযরত আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য।
এখান
থেকে সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) তাঁর সঙ্গে আনিত এক হাজার অশ্বারোহী
ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্য এবং হযরত শাহ জালাল ২৪০ জন সঙ্গীসহচর সহ সোনারগাঁ অভিমুখে
সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
সোনারগাঁ
পৌছানোর পর দিল্লীর সুলতানী আদেশানুসারে হযরত শাহ জালাল (রহ.) ও সিকান্দর গাজী সম্মতিক্রমে
সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) সেনা বাহিনীর প্রধান হয়ে সিলেট অভিযানে
রওয়ানা হন।
সিলেট
আসার পথে বিভিন্ন স্থানে হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায়
শ্রীহট্টের (সিলেট) রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হয়। হযরত শাহ জালাল (রহ.) সিপাহসালার
হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) এর নেতৃত্বে নিজ সৈন্য বাহিনী নিয়ে সিলেটের চৌকি পরগনায়
উপস্থিত হইলে রাজা গৌড় গোবিন্দ তাদেরকে প্রতিরোধ করার লক্ষে যাদু-মন্ত্র সহ এক প্রকাণ্ড
লৌহ ধুনুক হযরত শাহ জালাল (রহ.) কাছে প্রেরণ করে । যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা
উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। হযরত শাহ জালাল
(রহ.) তার দলের লোকদের ডেকে বললেন; যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাজা
হয় নাই বা বাদ পরে নাই একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক "জ্যা" করতে।
অতপর মুসলিম সৈন্য দলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.)
কে দিয়ে ধনুক জ্যা করলেন।
সিলেট
বিজয় সমাপ্ত করে হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর আদেশে বারজন আউলিয়াকে সঙ্গী নিয়ে ১৩০৪ সালে
তরফের সামন্ত ত্রিপুরা রাজা আচানক নারায়নকে শায়েস্তা করতে তরফ রাজ্যে গমন করেন। তরফের
অত্যাচারী ত্রিপুরা রাজা আউলিয়াগণের আগমন সংবাদ অবগত হয়ে বিনা সমরে রাজ্য পরিত্যাগ
করে ত্রিপুরার রাজাদের আশ্রয়ে চলে যায়। তরফ রাজ্য সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন
(রহ.) এর অধিকারে আসে। তিনি তাঁর সাথে আগমনকারী বার জন আউলিয়া তরফ রাজ্যে বসবাস শুরু
করেন। পরে এটি বার আউলিয়ার মুলুক বলে খ্যাত হয়।
অতপর
তরফে মুসলমানদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, উক্ত বার আউলিয়া ইসলামের বাণী নিয়ে ভিন্ন
ভিন্ন স্থানে গমন পূর্বক ধর্ম সাধনায় নিয়োজিত হন। তাদের অধ্যুষিত স্থানে নিজ নিজ
নামে একেকটি দরগাহ বা মাজার বিদ্যমান আছে।
এদিকে
সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। তিনি সৈন্য গণ
সহ যে স্থানে বাস করে রাজ্য পরিচালনা করেন, সে স্থান লস্করপুর নামে খাত্য হয়।
সিপাহসালার
হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) সময় সময় সিলেট গিয়ে হযরত শাহ জালালের সাথে সাক্ষাত
করতেন।
এক
সময় তিনি এক স্বপ্ন দেখে বুঝতে পারেন যে তার পরকালের যাত্রার ডাক এসে গেছেন। তাই তিনি
সিলেট গমন পূর্বক হযরত শাহ জালাল (রহ.) সাথে শেষ দেখা করেন।
সিপাহসালার
হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) ১৩৪৬ সালে (৭৪–৭৫) বছর বয়সে ওফাত লাভ করেন। তবে ওফাতের
পূর্বে তিনি তাঁর মুরীদদেরকে নসিয়ত করেছিলেন; মৃত্যুর পরে তাকে যেন পূর্ব পশ্চিম করে
দাফন করা হয়।
কিন্তু তাঁর ওফাতের পর তৎকালীন আলিম সমাজের
আপত্তির মুখে সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) এর ভক্ত মুরীদগন তাঁর
নসিয়ত উপেক্ষা করে ইসলামি নিয়মানুসারে তাকে উত্তর দক্ষিণ করেই দাফন করেন।
দাফন কার্য্য শেষে সকল লোক তাঁর
হতে চল্লিশ কদমের ব্যবধান পার হতে না হতেই এক প্রকণ্ড শব্দ শুনে উপস্থিত লোক জন পিছে
ফিরে তাকিয়ে দেখতে পান সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) এর করব মোবারক মুড়ে গিয়ে
পূর্ব পশ্চিম হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ সকলে ইসলামিক কলেমা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে এই
আউলিয়ার শেষ নসিয়তের কথা স্মরণে নিজের ভুল স্বীকারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা
করেন।
সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায় মুড়ারবন্দ
নামক স্থানে সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) এর মাজার অবস্থিত।
সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন
(রহ.) পরে তার পুত্র হযরত সিরাজ উদ্দীন (রহ.) তরফের শাসনভার প্রাপ্ত হন। এই হযরত
সিরাজ উদ্দীন (রহ.) থেকে সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহ.) বংশ বিস্তৃত হয়।
পরবর্তীতে তার বংশ হতে ওলী-আউলিয়া, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ সহ অনেক জ্ঞানী-গুণীর আবির্ভাব
ঘটে। মুলক-উল-উলামা, আরাকান রাজ্যের রাজ দরবারী সৈয়দ মুসা, কুতুব-উল-আউলিয়া, বিখ্যাত
সাধক গদাহাসন, শাহ নূরী, মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান, সাধক ও সমাজ সংস্কারক সৈয়দ
গোয়াস উদ্দীন, ঐতিহাসিক সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ মোস্তফা আলী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী,
সৈয়দ মোস্তফা কামাল, সৈয়দ মোহাম্মদ জোবায়ের যাঁদের মধ্য অন্যতম।
0 Comments