
হযরত
শাহ মখদুম রুপশ (রহ.) ১২১৬ (হিজরী ৬১৫ সালের ২রা রজব) সালে বাগদাদের এক বিখ্যাত
সুফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী(রহ.) এর
মৃত্যুর ৫৪ বছর পর হযরত শাহ মখদুমের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম হযরত সায়্যিদ
আযাল্লাহ শাহ (রহ.) তিনিও আল্লাহর অলী ছিলেন।
১২৫৮
সালে তাতারীদের হাতে বাগদাদ নগরীর পতন ঘটে । বাগদাদ নগরীর পতন হওয়ার আগেই পিতা
আযাল্লাহ শাহের সাথে শাহ মখদুম বাগদাদ ত্যাগ করে ভারতের দিল্লীতে এসে বসবাস
শুরু করেন।
৬৮৫
হিজরিতে (১২৮৬ সালে তিনি তাঁর বড় ভাই সৈয়দ আহমদ ওরফে মীরন শাহকে নিয়ে
বাগদাদ হতে নৌপথে এখানে আসেন।হযরত মীরন শাহ (রহ.) লক্ষ্মীপুর জেলার
কাঞ্চনপুরে এবং হযরত মখদুম শাহ (রহ.) কাঞ্চনপুরের সন্নিকটে শ্যামপুরে স্ব
স্ব খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি তাঁর সঙ্গী সৈয়দ শাহ আববাস, সৈয়দ দিলাল
বোখারী, শাহ সুলতান এবং শাহ করম আলীকে নিয়ে বাঘায় চলে যান (রাজশাহী জেলার চারঘাট
থানায়)।
প্রচলিত
কাহিনী অনুসারে চিশতিয়া তরিকার একটি উপদলের আউলিয়াদের মতো তিনি তাঁর মুখমন্ডল
একটুকরা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন এবং এজন্য তাঁকে রূপস বলা হতো। শীঘ্রই তাঁর
আবাসস্থল বাঘার নামকররণ করা হয় মখদুমনগর।
৬৮৭
হিজরিতে (১২৮৮ সালে) রামপুর বোয়ালিয়ায় হযরত তুরকান শাহের শহীদ হওয়ার সংবাদ শুনে
হযরত শাহ মখদুম রূপস (রহ.) বাঘা হতে রামপুর বোয়ালিয়ায় চলে আসেন। সমাজ থেকে
অনাচার অত্যাচার দুর করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য শাহ্ মখদুম (রহ.) কে তিন তিন বার
দেও রাজার সাথে যুদ্ধ করতে হয়।
প্রথম
বারে তিনি তার লোকজন নিয়ে দেও রাজপ্রসাদ ঘিরে রাখেন। দেও ধর্মালম্বীগণ সমবেত হয়ে যুদ্ধ
করে অনেক দেও ধর্মালম্বী মারা গেল। হযরত শাহ মখদুম (রহ.) এর পক্ষেও কিছু লোক শহীদ
হলেন। শেষ দিনের যুদ্ধে হযরত শাহ মখদুম রূপস (রহ.) এর সাথীদের কিছু ঘোড়া
শহীদ হল। যেখানে ঘোড়া শহীদ হয় উক্ত স্থানটি ঘোড়ামারা নামে খ্যাত। রাজশাহী শহরের
ঘোড়ামারায় বর্তমানে একটা পোষ্ট অফিস রয়েছে।
দৈত্য
ধর্মালম্বীগণ বুঝতে পারল হযরত শাহ মখদুম রূপস (রহ.) কে না তাড়াতে পারলে
তাদের কোন শান্তি নেই। তাই তারা দিক দিগন্তে সংবাদ পাঠিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে
লাগল।
হযরত
শাহ মখদুম (রহ.) ধ্যানে উহা জানতে পেরে তাদের প্রতিরোধের জন্য স্থানে স্থানে তাঁর
অনুসারীদের সবাইকে মোতায়েন করলেন এবং নিজেও এ যু্দ্ধ শরীক হলেন। বহু দৈত্য
ধর্মলম্বী ধরাশায়ী হল। কিছু সংখ্যাক পালিয়ে গেল, মঠ মন্দির ভেঙ্গেচুরে লুট হল।
যাদুর কুন্ডের দ্বারা দৈত্য ধর্মলম্বীগণ কোন ফল পেল না। কেননা হযরত শাহ মখদুম
(রহ.) পূর্বেই তা তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা নষ্ট করে রেখেছিলেন।
মঠ
মন্দিরের সে বড় বড় পাথর ও পাথর মুর্তি আজও রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়।
লোকজন সেগুলি বসা ও শোয়ার আসন হিসাবে নানাবিধ কাজে ব্যবহার করে আসছে। দৈত্য রাজ
সপরিবারে পালিয়ে জীবন রক্ষা করল। মহাকাল গড়ের যুদ্ধের শহীদদের কবর মখদুম মাযার
প্রাঙ্গণে আজও বিদ্যমান যা সে যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। হযরত শাহ মখদুম
(রহ.) বিজয়ীর বেশে মখদুম নগরে ফিরে গেলেন। এ শুভ সাংবাদে মখদুম নগরে আল্লাহ ও
রাছুলের জয়ধ্বনী পড়ে গেল। এ বিজয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে দ্বীন ইসলামের নামে ৭২৬
হিজরীতে এক প্রকান্ড ও অতি উচ্চ বিজয়ী সদর দরজা প্রস্তুত করা হল। ঐ দরজার পাথর
ফলকে সে বৃত্তান্ত লেখা ছিল। এ তোরনের ধংসাবশেষ কালের সাক্ষী হয়ে আজও মখদুম নগরে
পদ্মার তীরে বিদ্যমান রয়েছে।
বনবাসী
দৈত্য রাজের নিকট পলাতক দৈত্য ধর্মলম্বীগন পুনরায় সমবেত হয়ে রাজ আজ্ঞায় জয়ের
আশীর্বাদ গ্রহনে তীর্থস্থান উদ্ধার কল্পে রামপুর বোয়ালিয়াতে উপস্থিত হওয়ার সংবাদ
পেয়ে হযরত শাহ মখদুম (রহ.) পুনরায় রামপুর বোয়ালিয়ায় আগমন করলেন এবং সমবেত দৈত্য
ধর্মলম্বীদের মধ্যে তাঁর পাক পা হাতে এক পাট খড়ম ছুড়ে মারলেন। হু হুংকার রবে
বিঘুর্নিত খড়মের আঘাতে বহু শত্রু ধরাশায়ী হল এবং কিছু সংখ্যক পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল।
ওদিকে দৈত্য রাজের দু পুত্রই মুখে রক্ত উঠে মারা গেল।
দৈত্যরাজ
ঘটনা উপলদ্ধি করতে পেরে মৃত পুত্রদয়ের লাশ নিয়ে এসে হযরত শাহ মখদুম (রহ.) এর
পায়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করল। তিনি তখন মৃতলাশ দ্বয়ের হাত ধরে বললেন, ঘুমাও মাত
উঠ। পুত্রদ্বয় উঠে বসল। দৈত্য রাজদ্বয় স্বপরিজনে ঈমান এনে মুসলমান হল। ইহা দেখে
দৈত্য ধর্মলম্বীগণ দলে দলে মুসলমান হল। মহাকালগড় দেও মন্দির স্থানেই শাহ মখদুম
(রহ.) এর আস্তানা স্থাপিত হল।
হযরত
শাহ মখদুম (রহ.) পানি পথে কুমির বাহনে, শূন্যপথে বসবার পীড়ি আসন বাহনে এবং স্থল
পথে সিংহ বা বাঘ বাহনে চলাফেরা করতেন। তাঁর এ অলৌকিক ঘটনা, বোজর্গী, কেরামতী এবং
অখন্ডন দোয়া ও বরদোয়া ইত্যাদি দেখে শুনে প্রায় সবাই ঈমান আনল।
হযরত
শাহ মখদুম (রহ.) তাঁর সঙ্গীদেরকে পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে ইসলাম প্রচারের জন্য
প্রেরণ করেন। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহীর বিভিন্ন
স্থানে তাঁদের মাজার রয়েছে। সৈয়দ শাহ আববাস, সৈয়দ দিলাল বুখারী, শাহ সুলতান এবং
শাহ করম আলীর মাজার যথাক্রমে বাঘা, দিলালপুর, সুলতানগঞ্জ ও বিড়ালদহে রয়েছে।
প্রায়
সিকি শতাক ধরে শাহ মখদুম বরেন্দ্র অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করে ৭১৩ হিজরির (১৩১৩ সাল)
২৭ রজব ওফাত লাভ করেন। রাজশাহী সরকারি কলেজের কাছে দরগাহ পাড়ায় তাঁর মাজার
রয়েছে। জনৈক আলীকুলী বেগ তাঁর কবরের উপর ১০৫৪ হিজরিতে (১৬৪৪ সাল) একটি ক্ষুদ্র
একগম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকার সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।
0 Comments