Header Ads Widget

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অলি-আল্লাহদের ভূমিকা

  

হযরত রাসূল (স.) কতৃক প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদী ইসলাম আরবভুমি থেকে ইহুদী-নাসরা এবং কাফির-মুশরিক এর মত বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের দূর্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে অঞ্চল থেকে অঞ্চলে দেশ থেকে দেশান্তরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে যা অতি অল্প সময়ে আরবের ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে বহিঃর্বিশ্বে নোঙর ফেলতে শুরু করে।

হযরত রাসূল (স.) ও তাঁরই যোগ্য সাথী সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদেরই উত্তরসূরী আউলিয়ায়ে কেরামদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অদ্বিতীয় কুরবানীর বিনিময়ে এ অসাধ্য যে সাধন হয়েছে তা অনস্বীকার্য। ঐশী শক্তি এবং রাসূল (স.) এর আদর্শই ছিল তাঁদের প্রধান হাতিয়ার।

সামুদ্রিক পথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাই ছিল তৎকালীন আরবদের জীবিকার প্রধান উৎস। আরবীয় বণিকদল ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করত। এমনিতে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। গাছ-পালা, নদী-নালা, পাহাড় পর্বতে সুসজ্জিত প্রাচ্যের রাণী এই চট্টগ্রাম।

তাছাড়া আরবদেশসহ বিভিন্ন দেশের সাথে রয়েছে চট্টগ্রামের সহজ সামুদ্রিক যোগাযোগ। সমুদ্র পথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে যাতায়তকালে চট্টগ্রামের মনোরম দৃশ্য আরবীয় বণিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক সোহেল মুহাম্মদ ফখরুদ-দীন তাঁর রচিত চট্টগ্রাম মুসলমান আগমনের ইতিকথা গ্রন্থের প্রথম সংস্করন ২০১৫ তে লিখেছেন, “নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কায় ইসলামের দাওয়াত শুরু করায় মক্কার শাসক গোষ্ঠি কুরাইশরা তাঁর উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন শুরু করে। অত্যাচারী কুরাইশরা ততোধিক নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে ইসলামের আহবানে সাড়া দেওয়া নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর। মক্কায় তাঁদের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁদেরকে আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়া) গমন করে আত্মরক্ষার অনুমতি দান করেন। সাহাবারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে আবিসিনিয়ায় গমন করেন।

৬১৩ খ্রিস্টাব্দে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা সাহাবী প্রথম ব্যাচে আরবের সুহাইবা বন্দর থেকে আবিসিনিয়ার অক্সামে গমন করেন। আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান রাজা আমা ইবনে আবজার (আল নাজাসী, নেগুস) তাঁদেরকে সাদরে বরণ করেন। দুই বছর পর ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলী (রাঃ) এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা জাফর ইবনে আবু তালিব (রাঃ)- এর নেতৃত্বে প্রায় একশ সদস্যের অপর একটি দল (৮৩ জন পুরুষ, ১৮ জন মহিলা) আবিসিনিয়ার অক্সামে পৌছান। ৬১৩ ও ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে নবী করীম (সাঃ) এর বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবা ছিলেন, যথা- সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে জাস (রাঃ), উসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ), (পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদিনের তৃতীয় খলিফা) ও তদীয় স্ত্রী রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদ (সাঃ) প্রমূখ। পরবর্তীকালে সাহাবারা আবিসিনিয়া থেকে মদিনায় ফিরে যান। কিন্তু সেই ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত রাসূল (সঃ) এর প্রিয় সাহাবী সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রহ.)অপর দুইজন সঙ্গী হযরত মামুন (রা.) ও হযরত মোহায়মেন (রা.) নিয়ে ইসলাম প্রচারেরউদ্দেশ্যে ইথিওপিয়ার অক্সাম বন্দর থেকে নৌপথে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছান। তিনিই প্রথম চট্টগ্রামবাসীদের নিকট ইসলামের বাণী পৌছে দেন। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে উপমহাদেশে চট্টগ্রাম সর্বাগ্রে ইসলামের অমিয় বাণীর সন্ধান পায়।

৬১৬ ও ৬৫১ সালে তাঁকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীনে পাঠানো হয়েছিল। চীনে ইসলাম তাঁর হাত ধরেই পরিচিতি পায়। ধারণা করা হয় চীনে যাওয়ার সময় নৌরুটে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে থেমেছেন এবং বাংলাকে ইসলামের সাথে পরিচয় করানোয় তাঁর অবদান আছে।

চট্টগ্রাম থেকে কামরূপ-মণিপুর হয়ে ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) চীনের ক্যান্টন শহরে যান।ক্যান্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হুই চাই (পরবর্তী কালে হুই হুই জনগোষ্ঠি নামে পরিচিত) জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের পর ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আরবে ফিরে যান।

হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ৬১০-৬১১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রসূল (সাঃ) এর প্রিয় সাহাবায় উন্নীত হন। ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ১৭তম ব্যক্তি। তিনি হযরতের মাতা আমিনা বিনতে ওয়াহাব (রাঃ) এর চাচাত ভাই ছিলেন। তিনি সুদক্ষ সেনাপতি ছিলেন।পারস্য সাম্রাজ্য (ইরান) বিজয়ে নেতৃত্ব দান করেন। ৬৩৭-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পারস্য সম্রাজ্যের রাজধানী টেসিফন এর গভর্নর এবং ৬৪৫-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার বুসরা আল শাম এলাকার গভর্নর ছিলেন। সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) আরব-চীন কূটনীতির পুরোধা হিসাবে ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন। হযরত সাদ ইবনে ওয়াক্কাস দ্বিতীয়বার চীনে যান ৬৫১ সালে। চীনের সম্রাট তুং-এর আমন্ত্রণে। সম্রাটের আগ্রহে তিনি ক্যান্টনে বর্তমান গুয়াংজু শহরে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর জন্ম আনুমানিক ৫৯৫ সালে মক্কায় এবং মৃত্যুবরণ করেন আনুমানিক ৬৭৪ সালে চীনের গুয়াংজুতে।

এছাড়াও দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) এর আমল হতেই স্থলপথে বিভিন্ন মুসলিম সেনাপতি বারবার সিন্ধুর সীমান্তে অভিযানে প্রেরণ করেন। অবশেষে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সময় সিন্ধু জয় করে ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রবেশের পথ সুগম করেন। তাই বলা হয় হিজরী প্রথম শতকেই ইসলাম ভারত উপমহাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

৭৭৮ খৃীষ্টাব্দ একদল মুসলিম বঙ্গোপসাগরে ঝড়ে পতিত হন এবং আরাকার রাজ্যের রাজা তাদের আশ্রয় দেন। রাজা তাদের ব্যবহার,বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে তার রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় দেন। এরপর সেখানে আস্তে আস্তে মুসলমান সমাজ গড়ে উঠে।

মুলতঃ খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী হতেই ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলসমূহে আরবরা উপনিবেশ গড়ে তোলেন এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। আরবীয় বণিকদল ব্যবসা পরিচালনার সাথে সাথে। এদেশের মানুষের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দেন। তাঁদের চরিত্র, আদর্শ এবং ধর্মীয় কার্যাদিতে মুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে এদেশের মানুষ মুসলমান হতে থাকে। তাছাড়া অনেক আরব বণিক এদেশের বহুবিধর্মী রমনীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এভাবে বহু স্থানীয় মহিলা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল। বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

বিশেষত আরবসহ বিভিন্ন দেশ হতে মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা প্রচারের জন্য অসংখ্য সূফী-সাধক ,অলী-আল্লাহ্, গাউস,কুতুব তথা বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক এই বাংলাদেশে সহ ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন। এক এক জন এক এক এলাকায় বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তাঁদের আদর্শ, চরিত্র, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এবং অলৌকিক কার্যাদিতে যুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলমীগণ তাঁদের হাতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে।

মূলত যে সকল সূফী সাধকের হাতেই বাংলাদেশে মোহাম্মদী ইসলামের প্রচার-প্রসার বেশী হয়েছে তাঁদের মধ্যে হযরত শাহ্ সুলতান বলখী (রহ.) ঢাকা, বগুড়া ও সন্দীপে, হযরত শাহ মোহাম্মদ সুলতান রুমী (রহ.) বর্তমান নেত্রকোণা,হযরত বাবা আদম শহীদ (রহ.)বিক্রমপুরে, হযরত মাধলুম দৌলা শহীদ (রহ.) শাহজাদপুর, হযরত জালালুদ্দিন তাবকিরী(রহ.) গৌড় অঞ্চলে, হযরত শাহ্ নিয়ামতুল্লাহ (রহ.) ঢাকায় এবং শাহ মাখদুম (রহ.)রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।

চট্টগ্রাম তো বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি এবং আউলিয়াদের শহর বলে সকলের কাছে পরিচিত। তাই চট্টগ্রামের বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে নদী সমুদ্রে, অলি-গলিতে কড় পীর-দরবেশ, অলি-আল্লাহর পূণ্যস্মৃতি বিজড়িত হয়ে আছে কে তার ইয়ত্তা করবে? এত অধিক সংখ্যক পূণ্যাত্মার সমাবেশ এদেশের অন্যত্র আছে কিনা সন্দেহ। যে সমস্ত পূণ্যাত্মাদের পদগুলির মাধ্যমে এ অঞ্চলে সর্ব প্রথম ইসলাম প্রচার প্রসার হয়েছে তাঁদের মধ্যে হযরত বদর শাহ (রহ.), সুলতানুল আরেফীন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহ.) হযরত শেখ ফরীদ চশমা (রহ.), হযরত কাতালখীর (রহ.) এবং হযরত শাহ চান্দ আউলিয়া (রহ.) প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বহু বিষয়ের পথ মূলত অষ্টম শতাব্দীর পূর্ব হতে উপরোল্লিখিত ধর্ম প্রচারকদের বদৌলতে সুগম হতে চলছিল।

রাসুলের শিক্ষা তথা মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা প্রচারের জন্য অসংখ্য অলী-আল্লাহ্, গাউস,কুতুব এই বাংলাদেশে আগমন করেছেন, এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক অলী-আল্লাহর আগমন সহ রওজা শরীফের অবস্থান ধারাবহিকভাবে বর্ণনা দেওয়া হল।

Post a Comment

0 Comments