হযরত শাহসূফি ছৈয়দ বাবা মোহছেন আউলিয়া (রহ.) ৮৮৬ হিজরী ৭২ বাংলা ১৪৬৬ সনে ১২ রবিউল আউয়াল জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার (রহ.) আদি নিবাস ইয়েমেনে। তাঁর পূর্ব পুরুষের পরিচয় জানা না গেলেও বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে তিনি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন।
ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি ইসলাম প্রচারে নেমে যান। তিনি ইয়েমেন থেকে প্রথমে ভারতে গৌড় রাজ্যে আগমন করেন। গৌড়রাজ্য তখন শিক্ষা, শিল্প সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। গৌড়রাজ্যে কিছুদিন অবস্থান করার পর হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া পানি পথে চট্টগ্রামে আগমন করেন।
হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে আসার সময় একমাত্র কন্যা শাহজাদী নুর জাহানকে সাথে নিয়ে আসেন। ভারতে থাকাকালীন তাঁর মেয়েকে তাঁর নিজ ভাতিজা হযরত শাহ সেকান্দর (রহ.) এর বিবাহ দেন ।
এরপর সেখান থেকে হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) তাঁর মামা হযরত বদর শাহ (রহ.)এর সাথে চট্টগ্রামে আগমন করেন এবং আনোয়ারা উপজেলার বটতলী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
তিনি তাঁর হযরত বদর শাহ (রহ.) এর দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন হিসেবে সবকিছু দেখা শোনাও করতে লাগলেন। এরই মধ্যে তাঁদের ঔরষে তিনজন শাহাজাদা যথাক্রমে-হযরত শাহ সুফী ছৈয়দ মনছুর (রহ.), হযরত শাহ সুফী ছৈয়দ কুতব (রহ.) ও হযরত শাহ সুফী ছৈয়দ ইব্রাহিম (রহ.) জন্মলাভ করেন। হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এই তিন আওলাদের দৌহিত্রের নামে ১০৭৭ হিজরী সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় গভর্নর বুজুর্গ নবাব ওমেদ খাঁ ১০ দ্রোন জমি করে একটি সনদ প্রদান করে। যা ঐতিহাসিক নবাবী সনদ নামে পরিচিত। বর্তমানে ঐ নবাবী সনদখানা দরগাহ পালা কমিটির নিকট সযত্নে রক্ষিত আছে।
কথিত আছে তিনি তাঁর ব্যবহৃত পাথরকে কিস্তি বানিয়ে পানি পথে চট্টগ্রামে আগমন করেন। তিনি চট্টগ্রামে এসে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত দেয়াং এর পাহাড়ে আস্তানা গাড়েন। দেয়াং এর পাহাড়ে অবস্থান করে তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা এবং মোহনীয় শক্তি সবাইকে মোহিত করত।
তাঁর অলৌকিক ঘটনা সম্পর্কে লোকমুখে জানা যায়, কোন একদিন নিঝুম নির্জন গ্রামের মাঠে এক বোবা ছেলে গরু, ছাগল দেখাশোনা করছিল। মোহছেন আউলিয়া (রহ.) ঐ ছেলেকে ডাকলেন তার সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে ছেলেটি বোবা। এ অবস্থায় তিনি বোবা ছেলের মুখে তার পবিত্র হাত মোবারক রাখলেন তখন সাথে সাথে ছেলেটি কথা বলতে আরম্ভ করল।
তিনি ছেলেটিকে বলল যাও, তোমার পিতা-মাতাকে ডেকে নিয়ে আস। সে তার বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে পারলে আশ্চার্য হয়ে মাতা-পিতা ও পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই বাবাজান কেবলার কাছে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) অলৌকিক পরিচয় পাওয়ার পর সে সময় দলে দলে মানুষ এসে তাঁর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে।
তিনি চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। অল্প সময়ের মাঝে তাঁর অসংখ্য ভক্ত এবং মুরীদ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সময় চট্টগ্রাম অবস্থান করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করে ৯৮৫ হিজরী ৯৭১ বাংলা ৬ আষাঢ় ১৫৬৫ , ১৩৯৭ সালে তিনি ওফাত লাভ করেন।
তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঝিউরী গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর কবর শরীফ শঙ্খ নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় কবর শরীফ নদীর ভাঙ্গঁনের কবলে পড়লে হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) বড় উঠানের একজন বিশিষ্ঠ জমিদারকে স্বপ্ন যোগে জানান যে, তাঁর কবর শরীফ বটতলীতে স্থানান্তরিত করা হোক। কিন্তু সেই বিশিষ্ঠ ব্যক্তি স্বপ্নের ব্যাপারটি গুরুত্ব দেয়নি। ফলে তার জমিদারি বিলুপ্ত হয় বলে শোনা যায়।
পরবর্তী পর্যায়ে বটতলীর অপর তিন ব্যক্তিকে তিনি স্বপ্নযোগে জানান, ঝিওরী গ্রামের শঙ্খ নদীর পাড়ে আমার কবর ভাঙ্গা অবস্থায় আছে, তার পার্শ্বে একটি পাথরও আছে। তোমরা আমার কফিন ও পাথরখানা নিয়ে বটতলী গ্রামের যেখানে সুবিশাল একটি বটগাছ এবং উলুবন সমৃদ্ধ জায়গা আছে সে স্থানে দাফন কর।ঐ তিন ব্যক্তি স্বপ্নের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দেন এবং স্বপ্নের আদেশ অনুযায়ী তারা এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তারা নদীর তীরে গিয়ে দেখতে পান পাথরের ওপর একটি লাশ ভেসে আছে। তারা ঐ লাশ বটতলীতে এনে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দাফন করে। যেখানে তাঁর লাশ দাফন করা হয় সেখানে এখন তাঁর পবিত্র মাজার শরীফ গড়ে উঠেছে। তিনি যে পাথর খন্ড করে ভেসে এসেছিলেন তা এখনও পর্যন্ত তাঁর পবিত্র মাজার শরীফে সংরক্ষিত আছে। এই পাথরটিকে অলৌকিক পাথর বলা হয়। বর্তমানে তার মাজার শরীফ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী গ্রামে অবস্থিত।
হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) রওজার উত্তর পাশে চাটি জ্বালানো হয়ে থাকে। চট্টগ্রামের জ্বিন-পরি তাড়ানোর কাজে তৈল ও চাটি ব্যবহার করেছেন বলে সেটির নিদর্শন হিসেবে এটি জ্বালানো হয় বলে জানা যায়। এছাড়া মোহছেন আউলিয়া (রহ.) রওজা শরীফের উপর চন (খড়) দিয়ে মেরামত করতে হয়।মাজারের পাশে তার ব্যবহৃত পাথরটি রয়েছে।
0 Comments